Bangladesh :verified:​ · @Bangladesh
59 followers · 121 posts · Server qoto.org

যে বাংলাদেশি পাইলট ইসরায়েলের ৪ টি বিমান ধ্বংস করেছিলেন!!

সাইফুল আজম ১৯৪১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) জেলার খগড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম নুরুল আমিন। বাবার কর্মসূত্রে তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল ভারতের কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের ভাগের সময় তার পরিবার ফিরে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ)। ১৫ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে, ১৯৫৬ সালে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান যান। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দুই বছর পর ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট অফিসার হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। একই বছর তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে।

সাইফুল আজমের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষণ বিমান সেসনা টি-৩৭ বিমান দিয়ে। প্রশিক্ষণ ও অ্যারিজোনার লুক এয়ার ফোর্স বেসে এফ-৮৬ সেব্রেসের উপর উচ্চ প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। এই কোর্সে তিনি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে টপ গান হিসেবে পাশ করেন। আরও পড়াশোনার পর ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ঢাকার কেন্দ্রে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি করাচির মৌরিপুর বর্তমানে যা মাশরুর এয়ার বেস এর টি-৩৩ বিমানের প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে কর্মরত থাকার সময় ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাইফুল আজম পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে যোগ দেন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবের বিমানকে তিনি ভূপাতিত করেন। পরে বিজয় মায়াদেবকে হিসেবে আটক করা হয়। ফলে তাকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক সিতারা–ই–জুরাত(সাহসিকতার তারকা) প্রদান করা হয়। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ২য় স্কোয়াড্রনের কমান্ড লাভ করেন।

১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে জর্দানের বিমানবাহিনী রয়্যাল জর্দানিয়ান এয়ার ফোর্সে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম। প্রতিনিধি পাঠানো দুজন পাকিস্তানি অফিসারের মধ্যে তিনি একজন ছিলেন। অন্যজন ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. সরোয়ার শাদ। সেখানে তিনি জর্দানের বিমানবাহিনীতে উপদেষ্টা হিসেবে পাইলটদের প্রশিক্ষণের কাজ করেন।

১৯৬৭ সালের ৫ জুন তৃতীয় আরব-ইসরায়েলি ছয়দিনের যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে মিশরীয় বিমান বাহিনীর সব বিমান অচল করে দেয়। বিমান বাহিনীর হামলা থেকে জর্দানের মূল বেস মাফরাকের প্রতিরক্ষার জন্য তাকে ডাকা হয়। সেসময় জর্দান বিমানবাহিনীর হয়ে সাইফুল আজম হকার হান্টার বিমান নিয়ে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর আক্রমণের আগমূহুর্তে জর্দানের বিমান বাহিনীর পক্ষে উড্ডয়ন করেন। তিনি অসামান্য এবং সাহসিকতার দৃষ্টান্ত রেখে তার বিমানের চেয়ে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির দুইটি ইসরায়েলি মিরাজ ফাইটার বিমান ভূপাতিত করেন।

দুইদিন পর তাকে ইরাকে জরুরি ভিত্তিতে বদলি করে পাঠানো হয়। তিনি ইরাকি বিমান বাহিনীর হয়ে ইসরায়েলি ফাইটারের মোকাবেলা করেন এবং ডগ ফাইটে একটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করেন। আক্রমণের সময় তিনি পশ্চিম ইরাকে ছিলেন। ইসরায়েলি পাইলট ক্যাপ্টেন গিডিওন ড্রোর সাইফুল আজমের উইংমেনসহ দুজন ইরাকি যোদ্ধাকে গুলি করতে সক্ষম হন, এর বিপরীতে সাইফুল আজম তাকে গুলি করতে সক্ষম হন। তিনি ক্যাপ্টেন গোলানের বোমারু বিমানকেও ভূপাতিত করতে সক্ষম হন। পরে দুই ইসরায়েলি বৈমানিককে যুদ্ধবন্দী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়।

এটি একটি রেকর্ড। দুই দিনের ব্যপ্তিতে তিনি দুইটি ভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করে ৪টি ইসরায়েলি ভূপাতিত করেন। এজন্য তাকে জর্দানের অর্ডার অব ইস্তিকলাল ও ইরাকি সাহসিকতা পদক নুত আল সুজাত প্রদান করা হয়।

১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেন। পাকিস্তানে ফেরার পর ১৯৬৯ সালে শেনিয়াং এফ-৬ জঙ্গি বিমানের ফ্লাইট কমান্ডার হন সাইফুল আজম । এরপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফাইটার লিডারস স্কুল-এর ফ্লাইট কমান্ডারের দায়িত্ব নেন তিনি।

সাইফুল আজম ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত সময় ফ্লাইট কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগেই আজম নিজেও পাকিস্তান এয়ারলাইন্স ও বিমান বাহিনীতে তার সহকর্মী বাঙালিদের সাথে গোপনে পরিকল্পনা করছিলেন করাচি থেকে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের একটি জেটবিমান ছিনতাই করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চের ৬ তারিখেই তিনি তার ও সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকায়। পরবর্তীতে সে আর সফল করতে পারেন নি।

১৯৭১ সালে সাইফুল আজম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের শুরুতেই তাঁর ওপর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে সাময়িকভাবে উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। রহমানের টি-৩৩ জঙ্গী বিমান নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় মতিউর শহীদ হবার পর পাকিস্তানের সংস্থা সাইফুল আজমকে রিমান্ডে নেয় এবং টানা ২১ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মতিউর রহমানের মৃত্যুর পরপর তাকে তার ব্যাচমেট পাকিস্তানি অফিসার সেসিল চৌধুরী করে নিয়ে যান এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করে রাখেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭৭ সালে উইং পদে উন্নীত হন। তাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক করা হয়েছিল। বিমান বাহিনীতে ডিরেক্টর অব সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশন্স হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি ঢাকা বিমানঘাঁটির কমান্ড লাভ করেন এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন তিনি

তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (ক্যাব) চেয়ারম্যান হিসেবে দুইবার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (এফডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়াও তিনি নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে ও নিজ স্ত্রীর সাথে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে ব্যবসায় যোগ দেন।

সাইফুল আজম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের হয়ে রাজনীতি করতেন। তিনি পাবনা-৩ আসন থেকে (চাটমোহর উপজেলা, ফরিদপুর উপজেলা ও ভাঙ্গুরা উপজেলা) পঞ্চম ও ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম (মেয়াদ ২০০২-২০০৭) সম্পর্কে তাঁর চাচাত ভাই ছিলেন। সাইফুল আজম নিশাত আজমকে বিবাহ করেন। নিশাত আজম একজন আইনজীবী। তাঁদের পুত্র এবং কন্যা সন্তান ছিলো।

সাইফুল আজম ২০২০ সালের ১৪ই জুন দুপুর ১টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকায় (সিএমএইচ) মৃত্যুবরণ করেন। ১৫ জুন ২০২০, সোমবার দুপুর পৌনে ২টায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার এর প্যারেড গ্রাউন্ডে (বিগটপ হ্যাঙ্গার) সাইফুল আজমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শাহীন কবরস্থানে তার মরদেহ সমাহিত করা হয় এবং একটি যুদ্ধবিমানের ফ্লাইপাস্ট আয়োজন করা হয়।

কৃতিত্বঃ
সাইফুল আজম একমাত্র পাইলট, যিনি যুদ্ধে চারটি বিমান বাহিনীর (বাংলাদেশ, জর্দান, ইরাক ও পাকিস্তান) হয়ে কাজ করেছেন। সেই সঙ্গে দুইটি ভিন্ন প্রতিপক্ষের (ভারত ও ইসরায়েল) বিরুদ্ধে লড়াই করার অনন্য কৃতিত্ব রয়েছে তার। ২০১২ সালে পাকিস্তান সরকারের মতে যেকোনো পাইলটের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলি ভূপাতিত করার রেকর্ড তার রয়েছে। তিনি মোট চারটি ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেন, যা এখন পর্যন্ত যেকোনো পাইলটের জন্য সর্বোচ্চ। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার লুক বেস থেকে নেওয়ার পর মার্কিন বিমান বাহিনী সাইফুল আজমকে টপ গান উপাধি দেয়।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক সিতারা–ই–জুরাত পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার কৃতিত্ব স্বরূপ জর্দান থেকে তাকে হুসাম-ই-ইস্তিকলাল সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
১৯৬৭ সালে ছয়দিনের কৃতিত্ব স্বরূপ ইরাকি সাহসিকতা পদক নুত-আল-শুজাত পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাকে।
যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলসের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
সাইফুল আজমের আটটি দেশের আটটি পৃথক বিমান বাহিনীতে পরিচালনার প্রশংসাপত্র রয়েছে। দেশগুলো হলো, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জর্দান, ইরাক, রাশিয়া, চীন এবং বাংলাদেশ।

ফিলিস্তিনের ইতিহাসবিদ ওসামা আল-আশ্কার প্রশংসা করে বলেন, “তিনি ছিলেন একজন মহান বৈমানিক”। তিনি আরো বলেন, “জেরুজালেমের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদকে প্রতিরোধ ও রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভ্রাতৃদ্বয় আমাদের অংশীদার ছিলো”। ফিলিস্তিনি অধ্যাপক নাজি শৌকরি বলেন, “সাইফুল আজম ফিলিস্তিনকে ভালোবাসতেন এবং জেরুজালেমের স্বার্থে লড়াই করেছিলেন”। খ্যাতনামা ফিলিস্তিনি তামির আল মিশাল তাকে “আকাশের ঈগল” বলে অভিহিত করেন।

@bengali_convo
@masindia

নিচের হ্যাস ট্যাগ গুলো ব্যবহার করুন:

#বন্দি #কমান্ডার #ফ্লাইট #bangla #kolkata #গোয়েন্দা #সামরিক #বিমান #ফোর্স #প্রশিক্ষণ #যুদ্ধে #bangladesh #bengali #bangladeshi #বাংলাদেশী #কলকাতা #বাংলা #বাঙালী #ঢাকা #পাবনা #দেশ #যুদ্ধবন্দী #ইসরায়েলি #দক্ষতা #বিমানঘাঁটি #স্ত্রী #পরিকল্পনা #বীরশ্রেষ্ঠ #মতিউর #এয়ার #সাংবাদিক #dhaka #বাংলাদেশ

Last updated 1 year ago

Bangladesh :verified:​ · @Bangladesh
57 followers · 110 posts · Server qoto.org

কাজী নজরুল ইসলামের, পুত্র বধূ উমা কাজী ❤️

বিদ্রোহী কবি সেবিকার যত্নে, মায়ের স্নেহে আগলে রেখেছিলেন যিনি, তিনি কাজী। এই ব্রাহ্মণ-কন্যাটি ছিলেন কবির পুত্র কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী, কবি নজরুলের

“যেখানেতে দেখি যাহা;

মা-এর মতন আহা।

একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,

মায়ের মতন এত

আদর সোহাগ সে তো

আর কোনোখানে কেহ পাইবে, ভাই !”

কাজী নজরুল ইসলাম নিজের ""বাদেও আর একজন নারীর মধ্যে নিজের মাকে খোঁজে পেয়েছিলেন ! যে নারী সন্তানের মতো নির্বাক ও প্রায় স্মৃতিশক্তিহীন কবি নজরুলকে মায়ের ভালোবাসায় আবদ্ধ রেখেছিলেন। আর স্নেহ-মায়া, ভালোবাসায় দিয়ে, যে সমস্ত রকম ভেদাভেদ দূর করা যায়, তার উদাহরণ উমা কাজী এই মানুষটি!

কাজী নজরুল-এর বড় ছেলে কাজী , অর্থাৎ নজরুলের পুত্রবধূ।

আসলে, তিনি ছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। পরিবারের কন্যা হয়েও পরিবারের পুত্রবধূ হয়েছিলেন ! সেই অনেক বছর আগে। উমার বাবা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং মা বাদলা মুখোপাধ্যায়। তার জন্ম বর্ধমানের কাটোয়া অঞ্চলে।

লেখাপড়া শেষ করে কলকাতার ‘লেডি ডাফরিন হাসপাতাল’ থেকে ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়েছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। থাকতেন সেখানকার নার্সিং হোস্টেলেই। ছোটকাল, থেকেই সেবিকা হতে চাইতেন তিনি। সেখানকারই এক হেড নার্স ঊষা দিদি, উমাকে এক নতুন পথের দিশা দেখান। উমাকে তিনি নিয়ে যান বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের বাড়ীতে। কবির সেবা করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক নার্সের। নির্বাক কবি তখন কলকাতার মানিকতলায় থাকতেন। নানা অসুস্থতায় জর্জরিত হলেও, দুই বাংলাতেই সমান্তরারালে তখন কবিকে নিয়ে কোনো অংশে উন্মাদনা কম নয়!

এমনই সময়ে কবির মাথার কাছে গিয়ে বসলেন উমা। নজরুলের স্ত্রী দেবী বলেছিলেন, “তুমি কি পারবে 'মা' কবির সেবা করতে ? ঐ যে দ্যাখো, উঁনি খবরের কাগজ ছিঁড়ছেন। উঁনি এখন শিশুর মতো।” এ প্রশ্নের উত্তরে উমা বলেছিলেন, “আমরা তো কলকাতার হাসপাতালে শিশু বিভাগেই ডিউটি করেছি। কবি যদি শিশুর মতো হন, তবে নিশ্চয়ই পারবো।”

ও স্নেহের পথ পরিক্রমায় উমাই হয়ে উঠলেন কবি নজরুলের প্রিয় মানুষ। তাঁকে স্নান করানো, খাওয়ানো, দেখ-ভাল করা, গল্প শোনানো। উমার হাতের স্পর্শ যেন কবির কাছে মায়ের আঁচলের মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু এরই মধ্যে উমার সেবার মনোবৃত্তি দেখে, মিষ্টি ব্যবহার দেখে কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী,উমার প্রেমে পড়ে গেলেন । উমাও সব্যসাচীকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেললেন।

হল ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের। সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রেখে, উমা মুসলিম পরিবারকে আপন করে নিলেন। মুসলিম ধর্মান্তরে উমা মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন, উমা কাজী। কবি ও কবিপত্নী প্রমীলা নজরুলও এমন এক মেয়েকে ঘরের বৌমা হিসেবে পেয়ে খুশি হলেন। উমা মুসলিম পদবী গ্রহণ করলেও, তাঁর নামে থেকে গেল দুর্গা'র চিহ্ন।

প্রমীলাদেবী উমা বৌমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। এদিকে কবি নিজেও বৌমা অন্তঃপ্রাণ। বৌমা চন্দন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে না দিলে স্নান করবেন না নজরুল, দাঁড়ি বৌমাই কেটে দেবে, খাইয়ে দেবে বৌমা। আদরের বৌমার কাছে শিশুর মতো আবদার বায়না করতেন কবি। এমনকি পরিধেয় জামাকাপড়ে নীল বোতলের আতর-সুগন্ধিও বৌমাকেই লাগিয়ে দিতে হবে।

উমা একদিকে নিজের নতুন সংসার সামলাচ্ছেন আর অন্যদিকে কবিকেও সামলাচ্ছেন। ধীরে ধীরে এল সব্যসাচী-উমার ঘরে তিন সন্তান,

- মিষ্টি কাজী,

- খিলখিল কাজী এবং

- বাবুল কাজী। তিন নাতি-নাতনি দাদা নজরুলের কাছেই থাকত বেশি সময়। কবিও তো শিশুর মতোই। সন্তানদের সঙ্গেই কবিকেও আসন পেতে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিতেন উমা কাজী।

পরবর্তীতে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সুস্থ করতে দুটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়, যে বোর্ডের সদস্যদের কবির সমস্যাগুলি বুঝিয়ে দিতে যেতেন, উমা নিজেই । কিভাবে কবির ফেরানো যাবে, কথা বলানো যাবে, এ সব ভাল করে শুনে সেবার ধরণও বুঝে নিতেন উমা। পাশাপাশি স্বামীর খেয়াল রাখা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, সবটাই দেখতেন উমা কাজী।

এরি মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শাশুড়ির সব দেখভালের দায়িত্বও নিলেন উমা কাজীই। কবির আগেই চলে গেলেন কবিপত্নী। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সংসার জীবনের পর, ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রমীলা কাজী। তাঁকে কলকাতা থেকে চুরুলিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাজী পাহালোয়ানের দরগার পাশে কবিপত্নীকে সমাহিত করা হয়।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর উদ্যোগে স্বপরিবারে কবিকে বাংলাদেশে আনা হয়। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডে (বর্তমান নজরুল ইনস্টিটিউট সংলগ্ন) কবি ভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন। কাজী কর্মসূত্রে কলকাতায় থেকে গেলেও উমা কাজী কবিকে দেখার জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ধানমণ্ডির বাড়িতে নজরুল নাতি-নাতনি নিয়ে খেলা করতেন, বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।

কবির জন্মদিন পালন হতো বেশ বড় করে। অতিথিরা আসতেন, কবিকে সবাই মালা পরাতেন । কবি সেইসব মালা পরে খিলখিল করে হাসতেন। হারমোনিয়াম দেখিয়ে সবাইকে বলতেন গান করতে। নাতি-নাতনিরাও নজরুল সঙ্গীত গাইতেন। নির্বাক কবিই কখনও হেসে উঠতেন আবার কখনও নির্বাক হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে যেতেন। একটার পর একটা নিজের সৃষ্টি শুনে। সব যন্ত্রণা যেন গানে গানে ঝরে পড়ত কবির চোখের জলে।

জীবনের দিকে বিছানাতে স্থায়ী ঠিকানা হলো কবির। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতেন উমা। তিনি যে সেবিকা থেকে ততদিনে তিনি যে কবির 'মা' হয়ে গিয়েছিলেন ! তাই, তো এত কিছুর মধ্যেও এতটুকু ফাঁক-ফোঁকর পড়েনি! ছেলে-মেয়েদেরকে বড় করার বা শাশুড়ির অবর্তমানে সমগ্র সংসার সামলানোর বা কাজী সব্যসাচীর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে উঠার।

২৯ আগস্ট ১৯৭৬ ইং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল হন। চির বিদায়ের শেষ সজ্জায় কবিকে সাজিয়েও দিয়েছেন উমা কাজী। তিন বছর পরে ১৯৭৯ সালের ২ মার্চ কলকাতায় মারা যান আবৃত্তিকার স্বামী কাজী সব্যসাচী। অকালেই চলে যান অসুখে। ফলে আরও কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে উমার কাঁধের উপর। তখন ম্লান হয়ে আসছে কাজী পরিবারের যশ-খ্যাতি। একা হাতে বিখ্যাত কবি পরিবারকে কঠিন লড়াইয়ের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেন উমা। তিনি না থাকলে কাজী পরিবার আজ খ্যাতি আর পরিচিতির জায়গাটা হয়তো ধরেই রাখত পারতো না। বিখ্যাত পরিবারে বিখ্যাত সদস্যদের পেছনে কাণ্ডারীর মতো শক্তির উৎস হয়ে উঠেছিলেন এই উমা মুখোপাধ্যায় তথা উমা কাজী।

উমা নিজেই যখন দাদী-নানী হলেন, তখন তিনিও কবির মতই তাঁর নাতি-নাতনিদের গল্প বলতেন। কাজী নজরুল, প্রমীলাদেবী, কাজী সব্যসাচী সকলের কথা তিনি বলতেন নাতি-নাতনিদের। তারাও কাজী নজরুলকে ছুঁতে পারত উমার গল্পে। উমা জানতেন, উত্তরাধিকারী নবীন প্রজন্মকে কবির কাজে আগ্রহী করলে কবির কাজ বেঁচে থাকবে, আরও এগুবে তাঁর সৃষ্টি। উমা যেন সারাজীবন কবির সেবিকা ও সাধিকা হয়ে রইলেন। এইভাবেই ৮০টি বসন্ত পেরিয়ে প্রয়াত হলেন উমা কাজী। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আর শেষ দিকে স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছিলেন, কবির মতোই। ১৫ জানুয়ারি ২০২০ইং সালে ঢাকার বনানীতে 'কবি ভবন'-এ প্রয়াত হন ভালোবাসার মনুষ্যত্ব ও সেবার ধর্ম সারাজীবন ধরে পালন করা মানুষ উমা কাজী। বনানীতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

কাজী বংশের এই শ্রেষ্ঠ "মা"কে বর্ণনা করা যায় নজরুলের কবিতা দিয়েই !

“হেরিলে মায়ের মুখ

দূরে যায় সব দুখ,

মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরাণ,

মায়ের শীতল কোলে

সকল যাতনা ভোলে

কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।

কত করি উৎপাত

আবদার দিন-রাত,

সব স'ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!

আমাদের মুখ চেয়ে

নিজে র’ন নাহি খেয়ে,

শত দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।”

অভিনন্দন ❤️🌸❤️

@bengali_convo
@masindia

নিচের হ্যাস ট্যাগ গুলো ব্যবহার করুন:

#বিদ্রোহী #পুত্রবধূ #মা #স্ত্রী #মুসলিম #মেডিকেল #অসুস্থ #প্রমীলা #সব্যসাচী #bangladesh #bangla #বাংলাদেশ #বাংলা #কাজী #নজরুল #ইসলামকে #শেষ #প্রয়াত #bengali #dhaka #bangladeshi #kolkata #কলকাতা #উমা #সব্যসাচীর #হিন্দু #ব্রাহ্মণ #কবি #তরুণী #সেবা #বিয়ে #শাশুড়ি #স্মৃতিশক্তি #কবিপত্নী #দেবী #বাঙালী #ঢাকা #বাংলাদেশী

Last updated 1 year ago